মেলাটোনিন: এক রহস্যময় হরমোন
এক রহস্যময় গ্রন্থি আর হরমোনের কথা বলা বলি। এই রহস্যময় গ্রন্থির নাম- পিনিয়াল গ্রন্থি। এই গ্রন্থি থেকে ক্ষরিত হরমোনের নাম- মেলাটোনিন হরমোন।
এই পিনিয়াল গ্রন্থিকে আমি বলি- লজ্জাবতী গ্রন্থি। আলো দেখলে লজ্জা পায়। আলোর সাথে ছোটবউ- ভাসুরের মতো সম্পর্ক। তাই দিনের আলোয় নয়, রাতের অন্ধকারে সে মেলাটোনিন ক্ষরন করে। সন্ধ্যায় সূর্য ডুবে রাত হলে মেলাটোনিন ক্ষরিত হতে শুরু করে। রাত দুটোই পিক লেভেলে থাকে। যেহেতু আলোর উপস্থিতি এরা বুঝতে পারে, আলো ও অন্ধকার আলাদা বুঝতে পারে, তাই পিনিয়াল গ্রন্থির নাম হলো- তৃতীয় চক্ষু (Third Eye) /পিনিয়াল চক্ষু /প্যারাইটাল চক্ষু। আলোর উপস্থিতি বুঝতে পিনিয়াল গ্রন্থি সাহায্য নেয় চোখের রেটিনার।
মেলাটোনিন নামক হরমোন ক্ষরণ হবার সাথেসাথে আমাদের শরীরে দুটো কাজ করে।
১. শরীরের তাপমাত্রা কমিয়ে দেয় (বিক্রিয়া কমলেই তাপমাত্রা কমে, ফলে প্রেশার ও হার্টবীটও কমে)।
২. শ্বাসপ্রশ্বাস কমিয়ে দেয়।
দুটো কাজ হলেই আমাদের ঘুম শুরু হয়, ঘুম গভীর ও প্রশান্তিময় হয়ে ওঠে।
যদি রাতে লাইট জ্বালিয়ে রাখি, মেলাটোনিন হরমোন ক্ষরিত হবে না। হলেও খুবই অল্প। ফলে ঠিকঠাক ঘুম হবে না। ঘুম যদি ঠিকঠাক না হয়, জেগেও উঠতে পারবো না ঠিক সময়ে। ঘুম ও জাগার ব্যাপার অনিয়ন্ত্রিত হলে খাবার সময় নিয়েও গন্ডগোল হবে। আমরা ঠিকঠাক না খেলে, কমবেশি খেলে ওজন বাড়বে কিংবা কমতে থাকবে। শরীর বেহাল হয়ে যাবে।
এই হরমোন কাজ করে আমাদের সার্কাডিয়ান সাইকেলের সাথে। সার্কাডিয়ান সাইকেল হল আমাদের শরীরের নিজস্ব ঘড়ি। সে বলে দেয়, কখন ঘুমাবে, কখন জাগবে, কখন খাবে, প্রেশার কেমন থাকবে, তাপমাত্রা, হরমোন লেভেল কেমন থাকবে।
শুধুমাত্র রাতে ঠিকঠাক না ঘুমালেই সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাবে। শুধুমাত্র হরমোনের ব্যালেন্স এলোমেলো হলে- ব্রণ হবে, চুল উঠবে, ওজন বাড়াকমা হবে, স্মরণ শক্তি কমে যাবে। ডায়াবেটিস ও ক্যান্সারের মতো রোগও একসময় শরীরে বাসা বাঁধতে পারে।
সবকিছু এড়াতে আমাদের উচিৎ রাত দশটার পর ঘুমের প্রস্তুতি শুরু করা, এগারোটার মাঝে ঘুমিয়ে যাওয়া। ভোরের সূর্যোদয়ের সাথে জেগে ওঠা।
খেয়াল করে দেখবে- কৃষক, নামাজী ও মন্দিরের পুরুতরা দীর্ঘজীবন লাভ করে। কারণ এরা সবাই ভোরে জাগে। ভোরে জাগতে হলে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হগ। কৃষকরা ক্লান্ত হয়ে সন্ধ্যার পর দ্রুত ঘুমিয়েও যায়।
আবার যে এলাকায় বিদ্যুত নেই, এরা দীর্ঘজীবন পায় (অজ পাড়াগাঁ /পাহাড়ি এলাকা)। কারণ সন্ধ্যার পরেই এই হরমোন ক্ষরণ শুরু হয়। বিদ্যুৎ ছাড়া অন্ধকারে থাকাদের ঘুমও আসে তাড়াতাড়ি।
এই হরমোন আবার ইনসমনিক লোকদের ঘুমের ঔষুধ হিসেবেও ব্যবহার করে।
কারো মনে যদি প্রশ্ন জাগে, এই হরমোন কী মোবাইলের আলোতেও কম ক্ষরণ হবে?
হ্যা।
যেহেতু চোখের রেটিনায় মোবাইলের আলো পড়ে, রেটিনা এই গ্রন্থিকে আলোর খবর পাঠায় তাই মোবাইল চাপলে, ইউটিউবিং ফেসবুকিং করলেই একই পরিমাণ প্রভাব সৃষ্টি হবে।
কোনোভাবে রাতে জেগে, দিনে ঘুমালে কী এই হরমোন ক্ষরণ হবে না?
হতে পারে। উন্নত দেশে যারা নাইট শিফটে কাজ করে, খেয়াল রাখা হয়- তারা যেন দীর্ঘদিন নাইট শিফটে কাজ করতে পারে তাহলে দিনের বেলা ঘরের অন্ধকারে তাদের এই হরমোন ক্ষরণ হয়। দিনের সাথে হরমোনের ক্ষরণের টাইমিং ম্যাচ হয়। যদি কেউ রাত জেগে কাজ করে দিনে ঘুমুতে চাও, তবে প্রপ্রিদি। একই সময়ে যেন অন্ধকার ঘরে ঘুমুতে পারো সেটা খেয়াল রাখবে। তবে মনে রাখবে- দিনের ঘুম কখনোই রাতের সমান নয়। ধর্মগ্রন্থেও বলা হয়েছে- দিন রুজির সন্ধানের জন্য, আর রাত বিশ্রামের জন্য।
যেহেতু এই হরমোন প্রেশার কমায়, হার্টবিট কমায়, টেম্পারেচার কমিয়ে শরীরকে প্রশান্তি দেয় তাই যারা খুব ভয় পায়, আতঙ্কে থাকে, তাদেরকেও এই হরমোন দিয়ে চিকিৎসা করা হয়।
মেলাটোনিন শব্দের অর্থ কী?
মেলানোস শব্দ Black বা কালো। অন্ধকার তো কালো। কালো বা অন্ধকারে ক্ষরণের কারণেই এর নাম- মেলানোস থেকে মেলাটোনিন।
তবে এরা পরোক্ষ্যভাবে শরীরের বর্ণেও ইফেক্ট ফেলে। নাইটকুইন নামক ক্ষতিকর রং ফর্সাকারী ক্রিম না মেখে বরং শান্তিময় ঘুম দিলেও গায়ের রঙ উজ্জ্বল হতে পারে।
এই হরমোন যে গ্রন্থি থেকে ক্ষরণ হয় তার নাম পিনিয়াল গ্রন্থি। পিনিয়াল অর্থ হলোঃ পাইন কোন। এই গ্রন্থি দেখতে পাইন কোনের মতো। পাইন কোন বোঝার সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হলো- ক্রিসমাস ট্রি কিংবা ঝালমুড়ির ত্রিকোনাকার ঠোঙ্গার মতো।
এই পাইন কোনের মতো বা ক্রিসমাস ট্রির মতো গ্রন্থিটির আঁকার একটি চালের দানার সমান। খেয়াল করো- পিট্যুইটারি গ্রন্থির আঁকার আবার মটরদানার সমান। দুটো আলাদা দানার সমান গ্রন্থির ইন্ট্রেস্টিং টপিক আজ বলা হলো। আরেকদিন পিট্যুইটারি নিয়ে ইন্ট্রেস্টিং ব্যাপারগুলো লেখা যাবে।
লেখাঃ রাজীব হোসাইন সরকার
➡️ বিস্তারিত জানতে: Read our Posts